কবর, মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কীত কতিপয় বিদ’আত
আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল
কবর, মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কীত কতিপয়
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,
আকাশে ঘন কালো মেঘের আড়ালে অনেক সময় সূর্য্যের কিরণ ঢাকা পড়ে
যায়। মনে হয় হয়ত আর সূর্য্যের মুখ দেখা যাবে না। কিন্তু সময়ের
ব্যাবধানে নিকশ কালো মেঘের বুক চিরে আলো ঝলমল সূর্য্য বের হয়ে
আসে। ঠিক তেমনি বর্তমানে আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা
যাবে বিদ’আতের কালিমা ইসলামের স্বচ্ছ আসমানকে ঘিরে ফেলেছে।
যার কারণে কোন কাজটা সুন্নাত আর কোন কাজটা বিদ’আত তা
পার্থক্য করাটাই অনেক মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। যা হোক শত
রকমের বিদ’আতের মধ্য থেকে এখানে শুধু কবর, মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কীত
কয়েকটি প্রসিদ্ধ বিদ’আত তুলে ধরা হল। যদিওএ সম্পর্ক আরও অনেক
বিদ’আত আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। যদি এতে আমাদের সমাজের
বিবেকবান মানুষের চেতনার দুয়ারে সামান্য আঘাত হানে তবেই এ
প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
১) মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা:
আজকেআমাদের সমাজে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী সন্তান-সন্ততি
ইত্যাদির মৃত বার্ষিকী অত্যন্ত জমজমাট ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।
সেখানে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে বিশাল খাবার-দাবারের আয়োজন
করা হয়। যদিও গরীব শ্রেণীর চেয়ে অর্থশালীদের মধ্যে এটা পালন করার
ব্যাপারটি বেশি চোখে পড়ে কিন্তু আমরা কজনে জানি বা জানার
চেষ্টা করি যে, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা কারো মৃত্য উপলক্ষ্যে শোক দিবস
পালন পালন করা জঘন্যতম বিদ্’আত? অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ উপলক্ষ্যে
শামিয়ানা টাঙ্গানো, ঘর-বাড়ী সাজানো, আলোকসজ্জা করা এবং
কুরআন তেলাওয়াত বা বিভিন্ন তাসবীহ-ওযীফা ইত্যাদি পাঠ করে
সেগুলোর সাওয়াব মৃতব্যক্তির রূহের উদ্দেশ্যে বখশানো বিদ’আত।
আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রাঃ) বলেন, “মৃত ব্যক্তিকে ছায়া দিতে পারে কেবল
তার আমল; তাঁবু টানিয়ে ছায়া দেয়া সম্ভব নয়।”
অনুরূপভাবে জানাযা দিয়ে ফিরে আসার পর জানাযায়
অংশগ্রহণকারীদেরকে, যে সমস্ত মানুষ শোক জানাতে আসে তাদেরকে
অথবা ফকীর-মিসকীনদের খানা খাওয়ানো, বৃহস্পতিবার, মৃত্যু বরণ করার
চল্লিশ দিন পর অথবা মৃত বার্ষিকীতে খাওয়ার অনুষ্ঠান করা, মীলাদ
মাহফিল করা, ‘চার কুল’ এর ওযিফা পড়া ইত্যাদি সবই হারাম এবং
বিদ’আতী কাজ। কারণ, নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
সুন্নত এবং সাহাবীগণের কার্যক্রমে এ সব কাজের কোন প্রমাণ নেই। এ সব
জীবিকা উপার্জন, অর্থ অপচয় এবং ধ্বংশের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়।
২) চল্লিশা পালন:
মানুষ মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন বিদ্আতঃপরে মৃতের চল্লিশা উপলক্ষ্যে
খানার আয়োজন করা অথবা চল্লিশদিন পর্যন্ত প্রত্যেক বৃহস্পতিবার শোক
পালন করা, মৃত্যুর পর প্রথম ঈদকে বিশেষভাবে শোকদিবস হিসেবে পালন
করা, সে দিন কুরআনের হাফেয বা কারী সাহেবদের ডেকে কুরআন পড়ানো
এবং শোক পালনের জন্য লোকজন একত্রিত করা ইত্যাদি সবই বিদ’আত এবং
হারাম।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এবং ইমাম ইব্ন মাজাহ (রহঃ) ছহীহ সনদে
আব্দুল্লাহ আল বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন “আমরা
মৃত্যুবরণকারী সাহাবীগনের কাফন-দাফন সম্পন্ন করে মৃতের বাড়ীতে
একত্রিত হওয়া এবং তাদের পক্ষ থেকে খাবারের আয়জন করাকে ‘নাওহা’
এর মতই মনে করতাম।” ইমাম আহমদ বলেন, “এটি একটি জাহেলী
কাজ।” নাওহা অর্থঃ কারো মৃত্যেুতে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা,
শরীরে আঘাত করা, চুল ছেড়া, জামা-কাপড় ছেড়া …ইত্যাদি। এসব কাজ
করা ইসলামে হারাম।
৩) নির্দিষ্ট কোন দিনে কবর যিয়ারতের জন্য একত্রিত হওয়া, হাফেজদের
দিয়ে কুরআন খতম করিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া ইত্যাদি।
ঈদ বা জুমার দিন পুরুষ-মহিলা একসাথে বা আলাদা আলাদাভাবে কবরের
পাশে একত্রিত হওয়া, খানা বিতরণ অথবা কিছু তথাকথিত মৌলোভী বা
কুরআনের হাফেজদেরকে একত্রিত করে কুরআন পড়িয়ে তাদেরকে
পারিশ্রমিক দেয়া ইত্যাদি কাজ সুস্পষ্ট বিদ’আত এবং নাজায়েয।
কবর যিয়ারতের জন্য জুমা বা ঈদের দিনের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট
প্রামাণিত নয়। অনুরূপভাবে কাবরের পাশে কুরআন পড়া বা পড়ানো একাটি
ভিত্তিহীন কাজ। একে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা
আরও বেশি অন্যায়।
৪) সবীনা পাঠ:
রমাযান বা অন্য মাসে সারারাত ধরে কুরআন খতম করানো এবং এজন্য
বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা রাসলুল্লাহ (সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্ল্লাম) এর শিক্ষা এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি বিরুদ্ধ
কাজ। নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবে এর দলীল নেই।
শরীয়তের দাবী হল, আমরা নিজেরা এ কুরআন পাঠ করব, নিজেদের মধ্যে
তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করব এবং কুরআনের মর্ম-উদ্দেশ্য বুঝার
জন্য গবেষণা করব।
রাসূল (সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল্লাম) এর নিয়ম ছিল, তিনি
রমাযানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য কোমর বেঁধে নামতেন, আর
বাড়ীর সবাইকে জাগিয়ে রাত জাগরণ করাতেন (বুখারী ও মুসলিম)। কিন’,
কুরআনের সবীনা পড়া করা অথবা হাফেজ সাহেবদের ডেকে অর্থের
বিনিময়ে কুরআন পড়ানোর কোন প্রমাণ নেই।
৫) রূহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের বিদ’আতঃ
নবী (সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল্লাম) এবং খেলাফয়ে
রাশেদীনের রূহের প্রতি ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ফরয নামাযের পর এই
বিশ্বাস সহকারে সূরা ফাতিহা পড়া বিদ’আত যে, এ সকল পবিত্র
রূহসমূহের উদ্দেশ্যে সূরা ফাতিহা পড়লে তাঁরা মৃত্যুর পর গোসল দেয়ার
সময় এবং কবরে সওয়াল-জওয়াবের সময় উপস্থিত থাকবেন। আফ্সোস! এটা
কত বড় মূর্খতা এবং গোমরাহী! এসব কথার না আছে ভিত্তি; না আছে
দলীল। এদের বিবেক দেখে বড় করুণা হয়।
অনুরূপভাবে, কোথাও কোথাও নামাযের শেষে দু’আ শেষ করে করে মৃতের
ফাতিহা পাঠের রেওয়াজ দেখা যায়। কোন জায়গায় জুমআর নামায শেষ
করে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের নিয়ম চালু
রয়েছে। এসবই বিদ’আত।
অনুরূপভাবে কোন কবর বা মাযারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেবলামুখী
হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং হাত উঠিয়ে কবর বা মাযারে মৃত ব্যক্তির
উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠ করা, আবার সে মৃত ব্যক্তির নিকটে ফরিয়াদ করা
বা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, মৃত মানুষের দাফন শেষে গোরস্থান
থেকে ফিরে আসার সময় চল্লিশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে ফাতিহা পাঠ করা
এবং সাধারণ মৃত মুসলমানদের রূহের উদ্দেশ্যে সাওয়াব রেসানীর
উদ্দেশ্যে ফাতিহা পড়া শুধু মূর্খতাই নয় বরং বিদ’আত।
৬) কবরে মান্নত পেশ, পশু যবেহ এবং খতমে কুরআনের বিদ’আত:
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কবরে খতমে কুরআন আয়োজন করা, পশু যবেহ করে
কুরআনখানী বা মৃতবার্ষিকীতে অংশ গ্রহণকারীদেরকে খানা খাওয়ানো
এবং কবরে টাকা-পয়সা মান্নত হিসেবে পেশ করা জঘন্যতম বিদ্’আত। এসব
কাজের সাথে যদি বিশ্বাস করা হয় যে, কবরবাসীরা এগুলোতে খুশি হয়ে
আমাদের উপকার করবে, আমাদেরকে ক্ষয়-ক্ষতি এবং বিপদাপদ থেকে
রক্ষা করবে এবং যদি বিশ্বাস করা হয় যে, তারা এ হাদিয়া-তোহফা
দিলে কবুল করেন তবে তা শুধু বিদ্’আতই নয় বরং বরং শির্ক। নবী
(সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল্লাম) এ ধরণের ক্রিয়াকলাপকে
লানত করেছেনঃ
(( ﻟَﻌَﻦ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻣَﻦْ ﺫَﺑَﺢَ ﻟِﻐَﻴْﺮِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ))
“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করে তার প্রতি আল্লাহর
অভিশম্পাত।” (মুসলিম, অধ্যায়ঃ গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা
হারাম)
মান্নত একটি ইবাদত। আর গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত করা শির্ক। নবী
(সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল্লাম) ইরশাদ করেনঃ
“এক ব্যক্তি একটি ছোট মাছির জন্য জান্নাতে গেছে এবং অন্য একজন
জাহান্নামে গেছে । সাহাবীগণ কারণ, জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,
“পূর্ববর্র্তী উম্মতের দু জন লোক সফরকালে এমন এক জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল
যেখানে ছিল একটি মূর্তি। মূর্তির সেবকগণ এ দু জন লোককে কোন কিছু
মূর্তির উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করতে আদেশ করল। এমনকি হুমকি দিয়ে
বলল, “অবশ্যই কিছু না কিছু উৎসর্গ করতে হবে। কমপক্ষে একটি মাছি হলেও
মূর্তির উদ্দেশ্যে দিতে হবে। অন্যথায় তোমাদেরকে হত্যা করা হবে।”
কোন উপায় না পেয়ে হয়ে দু জনের মধ্যে একজন একটি মাছি ধরে মূর্তির
মন্ডপে নিক্ষেপ করল। যার ফলে সে জাহান্নামে স’ন্তান করে নিল।
আরেকজন কোন কিছু দিতে অস্বীকার করল। ফলে তাকে হত্যা করা হল এবং
সে জান্নাতবাসী হয়ে গেল। (ছহীহ মুসলিম)
৭) কবরে ফাতিহা খানী করাঃ
নির্দিষ্ট সংখ্যায় সূরা ফাতেহা পড়ে তার সাওয়াব কবরে মৃতদের
উদ্দেশ্যে বখশানোএকটি ভিত্তিহীন কাজ।ইসলামী শরীয়তে যার কোন
প্রমাণ নেই।
আবদুল্লাহ ইব্ন উমার (রাঃ) কবরের নিকট সুরা ফাতিহা এবং সূরা
বাকারার শেষাংশ তেলাওয়াতের উপর গুরুত্ব দিতেন বলে যে একটি
বর্ণনা প্রসিদ্ধ তা একটি ‘শায’ এবং সনদ বিহীন বর্ণনা। তাছাড়া
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে থেকে কেউ তার সমর্থন করেছেন বলে প্রমাণ
পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে সূরা নাস, ফালাক, তাকাসূর, কাফেরুন ইত্যাদি পড়ে সেগুলোর
সাওয়াব মৃতদের উদ্দেশ্যে বখশানো একটি বাতিল প্রথা।নবী
(সাল্লাল্ল্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল্লাম) এর বক্তব্য এবং সাহাবায়ে
কেরামের কার্যক্রমে তার কোন সর্মথন পাওয়া যায় না। অথচ সব
ভিত্তিহীন বিদআতী কার্যক্রম আমরা নির্দিধায় করে যাচ্ছি। কোন
দিন এগুলোর দলীল তলিয়ে দেখার গরজ আমাদের হয় নি।
৮) পথের ধারে বা মাযারে কুরআন পাঠঃ
মাযার, পথের ধারে বা লোক সমাগম হয় এমন কোন স্থানে কুরআন
তেলাওয়াত করে ভিক্ষা করা বিদ’আত এবং হারাম। কেননা, মহাগ্রন্থ
কুরআনকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ। এর মাধ্যমে
আল্লাহর কালামকে অপমান করা হয়। ইসলাম সাধারণভাবে
ভিক্ষাবৃত্তিকেই তো নিন্দা করেছে আবার কুরআনকে মাধ্যম ধরে ভিক্ষা
করা?! এটা শুধু হারামই নয় বরং কঠিন গুনাহের কাজ।
এভাবে অসংখ্য বিদআত আমাদের সমাজে জেঁকে বসে আছে যেগুলোর
প্রতিবাদ করতে গেলেও হয়ত প্রতিবাদকারীকে উল্টো বিদআতী উপাধী
নিয়ে ফিরে আসতে হবে।
তবে বর্তমানে জ্ঞান চর্চার অবাধ সুযোগে আমাদের নতুন প্রজন্ম, যুব
সমাজ, তরুন আলেম সমাজ সবাই যদি উন্মুক্ত হৃদয়ে দ্বীনে ইসলামের বুক
থেকে বিদআতের পাথরকে সরানোর জন্য তৎপর হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে
ইসলাম তার আগের মহিমায় ভাস্বর হবে। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য্যে ভরে
উঠবে আমাদের সপ্নিল বসুন্ধরা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।
n
উত্তরমুছুন